জিম্বাবুয়ের একটা গল্প সবাই প্রায় জানি। সেখানে গাড়ির পেছনে বস্তায় করে টাকা নিয়ে একটা পাউরুটি বা একটা মাছ কিনতে হয়। তাদের কত টাকার ব্যাংক নোট আছে জানেন?
১০০ বিলিয়ন! ১ মিলিয়ন! এমন কি ট্রিলিয়ন টাকারও ব্যাংক নোট আছে!
এরপর ভেনিজুয়েলায়ও একই। এখন আবার নেপালেও এমন অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
- এটাকে কি বলে?
- কেন এমন হয়? এক দেশে পাউরুটি কিনতে একটা নোট লাগে, আর অন্য দেশে "এক বস্তা" টাকার প্রয়োজন হয়?
যখন অর্থের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়, অর্থাৎ একটা পণ্য কিনতে পূর্বের চেয়ে বেশি অর্থের প্রয়োজন হয়, সে অবস্থাকে মুদ্রাস্ফীতি বলে।
কোন নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য বা সেবার মূল্য টাকার অঙ্কে যখন বেড়ে যায়, অর্থনীতিতে তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়। সাধারণত কোন পণ্য দ্রব্যের দাম বেড়ে গেলে নির্দিষ্ট মুদ্রা দিয়ে ঐ একই পণ্য ক্রয় করতে বেশি পরিমাণ মুদ্রার প্রয়োজন পড়ে কিংবা একই পরিমাণ মুদ্রা দিয়ে আগের চেয়ে পরিমাণে কম পাওয়া যায়।
অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতির ফলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। আমরা যে বিষয়েই পড়াশোনা করি না কেন, মুদ্রাস্ফীতি সম্পর্কে ধারণা রাখা জরুরি।
মুদ্রাস্ফীতি বাড়লে কী সমস্যা হয়?
মুদ্রাস্ফীতির কারণে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য তীব্র হয়। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে উৎপাদকের - Producer (ধরা যাক,কারখানার মালিক) আয় বাড়ে, কিন্তু ক্রেতার বা ভোক্তার সঞ্চয় কমতে থাকে। আর একদম প্রান্তিক মানুষের যেমন ভূমিহীন কৃষকদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে।
মুদ্রাস্ফীতির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত, যাদের উপার্জন নির্দিষ্ট।
অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতির কারাণে যে ঋণ নেয় সে লাভবান হয় এবং পাওনাদার বা ঋণদাতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেন বুঝতে পারছেন? না পারলে কমেন্ট করুন!
মুদ্রাস্ফীতির প্রকারভেদ
১। বাড়ন্ত চাহিদাজনিত মুদ্রাস্ফীতি (Demand Pull Inflation)
যখন কোনো পণ্যের চাহিদা বাড়ে কিন্তু তার সাপেক্ষে উৎপাদন অথবা যোগান বাড়ে না বা অপরিবর্তিত থাকে, তখন সেই দ্রব্যের দাম বাড়ে। এটা খুবই স্বাভাবিক।
২। উৎপাদনখরচ বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি (Cost Push Inflation)
যখন কোনো জিনিস তৈরির কাঁচামালের দাম বেড়ে যায় ,তখন সামগ্রিকভাবে দ্রব্যটির মূল্যবৃদ্ধি ঘটে।
Hyperinflation
মুদ্রাস্ফীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হলো Hyperinflation! জিম্বাবুয়ে বা ভেনিজুয়েলায় যেটা হল!
যখন দ্রব্যের দাম বাড়তে বাড়তে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়, তখন তাকে "হাইপারইনফ্লেশন" বলে। মাসিক মূল্যবৃদ্ধির হার অন্তত ৫০% হলে তাকে হাইপারইনফ্লেশন বলে ধরা হয়।
হাইপারইনফ্লেশন ঘটার প্রধান কারণ হল সরকার কর্তৃক অনিয়ন্ত্রিতভাবে নোট ছাপানো। নোট যত বেশি ছাপানো হবে ,তত বেশি টাকা মানুষের পকেটে আসে, অন্যদিকে একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট দেশে হঠাৎ করেই উৎপাদন বাড়ানো যায় না। অর্থ হাতে বেশি থাকায় চাহিদার পরিমাণ বাড়ে, কিন্তু দ্রব্য বাজারে কম থাকায় মূল্য বৃদ্ধি পায়। সেই মূল্য বৃদ্ধিকে সামাল দিতে সরকার আবার নোট ছাপায়, তখন মুদ্রাস্ফীতি আরো বেড়ে যায়।
২০০৭-০৮ সালে জিম্বাবুয়েতে ঠিক এটাই হয়েছিল ! অনিয়ন্ত্রিত পরিকল্পনাহীন নোট ছাপানোর কারণে ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে সেই দেশের মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৯৬০০০০০০০০%!
Inflation in Zimbabwe |
এছাড়া যুদ্ধ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদির কোনো দেশের উৎপাদনশীলতা এবং বাজারে পণ্যের যোগান কমিয়ে হাইপারইনফ্লেশন ঘটাতে পারে।
মুদ্রাস্ফীতি কেন হয়?
- মানুষের হাতে অতিরিক্ত অর্থ থাকলে।
- কালোবাজারি বাড়লে।
- জনসংখ্যা বৃদ্ধি।
-সরকারের খরচ বৃদ্ধি
-সরকারের বৈদেশিক বাণিজ্যিক ঋণ বাড়লে।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কীভাবে করা হয়?
কোনো দেশের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (যেমন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নাম বাংলাদেশ ব্যাংক)এবং সরকার একসাথে পরিকল্পনা করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকল্পনাকে বলা হয় "মানিটরি পলিসি"(Monetary Policy) এবং সরকারের পদক্ষেপগুলিকে বলা হয় " ফিসকাল পলিসি"(Fiscal Policy)।
কিন্তু এগুলো কীভাবে কাজ করে?
যখন মুদ্রাস্ফীতি খুব বেড়ে যায়,অর্থাৎ সাধারণত বাজারে প্রচুর টাকা চলে আসে, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক "ব্যাংক রেট" বাড়িয়ে দেয়। এর কারণে অন্যান্য ব্যাংক গুলোও তাদের বিভিন্ন ঋণের সুদের পরিমাণ বাড়াতে বাধ্য হয়। ঋণের সুদের হার বাড়লে খুব স্বাভাবিকভাবেই মানুষ কম ঋণ কম নিবে, এতে মানুষের হাতে টাকা কম থাকবে। কম থাকলে কম খরচ করবে, পণ্যের জন্যে বেশি দাম দিতে পারবে না, বেশি দাম দিতে না পারলে বিক্রেতাও আস্তেধীরে দাম কমানো শুরু করবে।
অন্যদিকে সরকারও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে বিভিন্ন নীতি নির্ধারণ করে থাকে।যেমন, অপ্রত্যক্ষ করের জন্য জিনিসের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলে সরকার বাজেটে কর কমায়। এতে দাম কমে যায়। আবার প্রয়োজনে উল্টাও করতে পারে।
Post a Comment