ইতিহাস
বাংলাদেশ হিমালয় থেকে উৎসরিত ৩টি বৃহৎ নদীঃ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার পলল দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। এটি পৃথিবীর একটি অন্যতম বৃহৎ বদ্বীপ। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রায় ৪০৫টি নদী প্রবাহিত হচ্ছে। এ নদীগুলোর মধ্যে ৫৭টি হচ্ছে আন্তঃসীমান্ত নদী যার মধ্যে ৫৪টি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন এবং ৩টি বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে অভিন্ন। আবহমানকাল ধরে নদীমাতৃক বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা আবর্তিত হচ্ছে এসকল নদীর পানিকে ঘিরে। এ তিনটি নদীর অববাহিকার মোট আয়তন প্রায় ১.৭২ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার, যার মাত্র ৭ শতাংশ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত। এসকল নদীর অন্যান্য অববাহিকাভূক্ত দেশ হচ্ছে ভারত, নেপাল, ভূটান ও চীন।
১৯৭২ সালের মার্চ মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও প্রজাতন্ত্রী ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের মধ্যে যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে দু’দেশের বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে অভিন্ন নদীর ব্যাপক জরিপ কার্যক্রম পরিচালন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণের বিস্তারিত প্রকল্প প্রণয়ন ও প্রধান প্রধান নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্পের উপর সমীক্ষা পরিচালন, উভয় দেশের জনগণের পারস্পরিক সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে এতদাঞ্চলের পানি সম্পদের ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার এবং বাংলাদেশের সাথে ভারত সংলগ্ন এলাকায় পাওয়ার গ্রীড সংযোজনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য স্থায়ী ভিত্তিতে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়। উক্ত ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের ২৪ নভেম্বর অংশগ্রহণকারী দুদেশের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত রেখে সর্বাধিক যৌথ ফলপ্রসূ প্রচেষ্টার মাধ্যমে অভিন্ন নদীসমূহ থেকে সর্বোচ্চ সুফল প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের স্ট্যাটিউট স্বাক্ষরিত হয়। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের বাংলাদেশ পক্ষের কাজ সম্পাদনে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংযুক্ত দপ্তর হিসেবে যৌথ নদী কমিশন, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ভিশন, মিশন ও কার্যাবলি
রূপকল্প (Vision)
টেকসই পানি নিরাপত্তার লক্ষ্যে আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন ও যৌথ ব্যবস্থাপনা।
অভিলক্ষ্য (Mission)
আন্তঃসীমান্ত নদী অববাহিকাভূক্ত দেশ এর সাথে পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর এবং পানি সম্পদের যৌথ ব্যবস্থাপনা।
কার্যাবলি (Function)
- আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি বণ্টন, যৌথ ব্যবস্থাপনা, বন্যা সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত বিনিময়, ভারতীয় এলাকায় প্রবাহ নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রম এবং সীমান্তবর্তী এলাকার বাঁধ ও নদীতীর সংরক্ষণমূলক কাজসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনার লক্ষ্যে ভারতের সাথে বৈঠক অনুষ্ঠান ও প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ।
- ১৯৯৬ সালের গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির আওতায় প্রতি বছর ১লা জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সময়কালে ভারতের ফারাক্কায় গঙ্গা নদীর যৌথ প্রবাহ পর্যবেক্ষণ ও পানি বণ্টন এবং বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ সেতুর নিকট যৌথ প্রবাহ পর্যবেক্ষণ সংশ্লিষ্ট সকল কার্যক্রম তত্ত্বাবধান।
- আন্তঃসীমান্ত নদী অববাহিকায় যৌথভাবে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি প্রশমন, পানি সম্পদের আহরণ ও উন্নয়ন, নেপালে প্রবাহ নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রম এবং গবেষণা ও কারিগরী সংক্রান্ত বিষয়ে নেপালের সাথে বৈঠক অনুষ্ঠান ও প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ।
- পানি সম্পদ ক্ষেত্রে সহযোগিতা, আন্তঃসীমান্ত নদী অববাহিকায় চীন কর্তৃক প্রবাহ নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রম, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বন্যা পূর্বাভাসের তথ্য-উপাত্ত বিনিময় ও সক্ষমতা বৃদ্ধি বিষয়ে আলোচনার জন্য চীনের সাথে বৈঠক অনুষ্ঠান ও প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ।
- যৌথ নদী কমিশন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সেচ ও নিষ্কাশন কমিশন (ICID)-এর বাংলাদেশের সচিবালয় হিসেবে কাজ করে। এছাড়া এই কমিশন ইন্টার-ইসলামিক নেটওয়ার্ক ফর ওয়াটার রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট এন্ড ম্যানেজমেন্ট (INWRDAM) এবং ওআইসি (OIC) এর পানি সম্পর্কিত বাংলাদেশের ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে ।
জেআরসির এর জন্ম এবং এর ৫০ বছরের ‘প্রাপ্তি’
যৌথ নদী ব্যবস্থাপনায় আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করতে ১৯৭২ সালে যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) গঠন করে প্রতিবেশী দুটি দেশ। সেচ, বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড় নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পানি সম্পদ ভাগাভাগির মতো বিষয়গুলো নিয়ে কারিগরী পর্যায়ে আলোচনাই ছিল এটির মূল উদ্দেশ্য। ১৯৭২ সালের মার্চে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী, সহযোগিতা এবং শান্তি চুক্তির অংশ হিসাবে গঠিত হয় জেআরসি।
জেআরসির কার্যপদ্ধতি (রুলস অব প্রসিজার) অনুসারে, বছরে চারটি সভা করার কথা এই সংস্থাটির। অর্থাৎ গত ৫২ বছরে ২০৮টি জেআরসির বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে দু’দেশের কারিগরী এই কমিশর সর্বোচ্চ ৩৮টি সভা অনুষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। জেআরসিরমন্ত্রী পর্যায়ের সর্বশেষ ৩৮তম বৈঠকটি প্রায় ১২ বছর পর ২০২২ সালের আগস্টে অনুষ্ঠিত হয়।
অর্ধ শতাব্দীরও বেশি পুরোনো এই কমিশনের সাফল্যের ঝুড়িতে প্রাপ্তি নিতান্তই সামান্য। কয়েক দশকের আলোচনার পর ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো দুই দেশ একটি সফল চুক্তি স্বাক্ষর করতে সক্ষম হয়। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত গঙ্গা পানি বন্টন চুক্তিটি দু’দেশের জন্য একটি বিরাট মাইলফলক হয়ে আছে। এই চুক্তি সইয়ের পর প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে পানি নিয়ে উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হয়। অনেকের মতে এই চুক্তির ফলে আন্তঃসীমান্ত নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে সহযোগিতার পথ প্রশস্ত হয়। তবে আশংকার বিষয় হচ্ছে যুগান্তকারী এই চুক্তিটির মেয়াদ আগামী দুই বছরের মধ্যে শেষ হতে চলেছে।
তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয় ১৯৮৩ সালে একটি স্বল্পমেয়াদী চুক্তির মাধ্যমে। এরপর ২০১১ সালে ১৫ বছরের জন্য তিস্তা নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে প্রস্তুত হয় দুই দেশ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জর বিরোধিতা জেরে চুক্তিটি স্থগিত হয়ে যায়।
জানতে চাইলে জেআরসি সদস্য মোহাম্মদ আবুল হোসেন বলেন, যদিও কমিটি একটি কারিগরি কমিটি হিসেবে তার ভূমিকা পালন করেছে এবং উভয় দেশের পানি সচিবদের পর্যালোচনার জন্য চুক্তির খসড়া তৈরি করে, কিন্তু তিস্তা নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে ঐকমত্যের অভাবে চুক্তিটি আনুষ্ঠানিকভাবে সইয়ের প্রচেষ্টা ধারাবাহিকভারে ব্যর্থ হয় ১৯৯৭, ১৯৯৯ এবং ২০০৩ সালে।
গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের সময় তৎকালীন জেআরসি সদস্য বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, রাজনৈতিক ঐকমত্য না থাকলে জেআরসি-এর উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। ২০১১ সালে মমতা ব্যানার্জীর বিরোধিতার জেরে ভেস্তে যাওয়া তিস্তা চুক্তির দিকটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এরপর থেকে জেআরসি বাংলাদেশ অধ্যায় চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ভারতীয় পক্ষের সাথে আলোচনা চালিয়ে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই হয়নি।”
Post a Comment