অপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় কি দরিদ্রতা বাড়ায়? - রাফিউ আহমেদ

 




 

পণ্য ক্রয় একটা আবশ্যিক ব্যাপার। পণ্যের হাতবদল না হলে জীবনধারণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। 

পণ্য এত জরুরী, তাহলে পণ্য কাকে বলে?  

মার্ক্সের মতে, যে কোন পণ্যের রয়েছে একটা গুণ, যা হলো তা মানুষের কোন প্রয়োজন বা চাহিদা মেটায়। এই চাহিদা হতে পারে বাস্তবিক, যেমন খাদ্যদ্রব্য, আবার কাল্পনিক বা বিলাস দ্রব্য, যেমন, রং ফর্সা করার ক্রীম।

 

পণ্য যেহেতু প্রয়োজন মিটায় বা সমস্যা সমাধান করে,

তাহলে প্রচুর পরিমাণে পণ্য উৎপাদন করলেই প্রায় সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু সেটা উৎপাদকরা করছে না কেন?

 

আপনি যত ইচ্ছা পণ্য চাইলেই উৎপাদন করতে পারবেন না। কারণ পণ্য উৎপাদন করার সম্পদ নির্দিষ্ট। যেহেতু পণ্যের সম্পদ নির্দিষ্ট তাই ধীরে ধীরে উৎপাদন যত বাড়তে থাকে সে পণ্যের দাম তত বাড়তে থাকে।  যেমন মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্যের দাম নির্ধারণ হয় ভোক্তা ও ক্রেতার দরকষাকষির মাধ্যমে। সাধারণত ক্রেতা বেশি ( সমস্যা/প্রয়োজন বেশি), পণ্য কম তাই দাম বাড়বে। 

 এখন ভাবনার বিষয় হচ্ছে,

পণ্যের হাতবদল হয় 'প্রয়োজন' এর ভিত্তিতে নয়, বরং 'অর্থ' এর ভিত্তিতে । 

যেমন ধরুন- একজন অভূক্ত ব্যক্তি খালি হাতে পাউরুটির দোকানে দাঁড়িয়ে আছে, আবার একজন ব্যক্তি (যিনি ক্ষুধার্ত নন) টাকা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তাহলে বিক্রেতা কার সাথে বিনিময় করবেন? অবশ্যই যার টাকা আছে তার সাথে। 

এটাকে আধুনিক সময়ের বর্বরতা বলা যাবে না, প্রাচীনকালে যখন "পণ্য বিনিময় প্রথা" ছিল, তখনো পণ্য না থাকলে খালি হাতে বিনিময় হত না। সে যাক, আজকের টপিক এটা না।


এখানে একটা অবস্থা কল্পনা করা যাক, 

মিস্টার 'কেরামত আলী' অনেক ধনী ব্যক্তি। তার বাসায় তিন জন মানুষ হলেও, নানান ব্রান্ডের মোবাইল আছে ৭ টা। তিন জন চারটা মোবাইল ব্যবহার করে, বাকি তিনটা অব্যবহৃত অবস্থায় বাসায় পরে থাকে।

 

মিস্টার কেরামত আলীর এই অতিরিক্ত তিনটা মোবাইল ক্রয় কি কোন সমস্যা সৃষ্টি করে? 

উত্তর নিয়ে না ভেবে আমরা বরং এর ব্যাখ্যা নিয়ে ভাবি। কেরামত আলীর প্রয়োজন / অভাব আছে চারটা মোবাইলের।  অর্থাৎ তার কাছে  চার নাম্বার, পাঁচ, ছয় ও সাত নাম্বার মোবাইলের উপযোগ শূন্য। 

তাহলে কিনলেন কেন? সাধারণত আমরা উপযোগ না থাকলে কিনি না, এবং অর্থ আমরা আমাদের কাছে রেখে দিতে চাই। এক্ষেত্রে উল্টো হল কেন?


অনেক কারণে হতে পারে, ভুল সিদ্ধান্ত, অর্থের প্রাচুর্যতা, বিলাসিতা ইত্যাদি।  

মিস্টার কেরামত আলী যেহেতু ধনী ব্যক্তি, সেক্ষেত্রে উনার অর্থের প্রাচুর্যতা ও বিলাসিতাকেই কারণ হিসেবে ধরা যায়। 

এখন যদি এমন কেরামত আলীর সংখ্যা বেশি হয়, যদি সবাই অপ্রয়োজনীয় ভাবে পণ্য কিনে বা স্বত্ব নিয়ে ফেলে তার প্রভাব কী হবে? 



এর প্রভাব বহুমুখী, তবে আমরা এখানে অর্থনৈতিক অংশকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো।


সাধারণভাবে দেখলে মনে হবে,

কেরামত আলী পণ্য কিনতে যে টাকা ব্যয় করবেন, সে টাকা তো মানুষের কাছেই যাচ্ছে। অর্থাৎ যথাযথ হস্তান্তর হয়ে অর্থনীতির ভারসাম্য ঠিক থাকবে।


কিন্তু সমস্যাটা হলো, শ্রমীকরা আর উৎপাদক নেই, তারা উৎপাদনের উপকরণ হয়ে গেছে। অর্থাৎ মোবাইল বিক্রির টাকার যে আধিক্য সেটা প্রায় পুরোপুরিভাবে মালিক/উৎপাদক নিজে ভোগ করে এবং শ্রমীকদের নামে মাত্র টাকা দেয়। যেহেতু শ্রমীকদের বড় পূঁজি নেই, তাই তারা কাজের ডায়মেনশন পরিবর্তন করতে পারে না। তাদের নানাবিধ অক্ষমতার সুযোগ নিয়ে উৎপাদক/মালিক তাদের Exploitation করে আরো বেশি মুনাফা করে, শ্রমীক বিদ্রোহ করার আগ পর্যন্ত করতে থাকে।

এখন ধরুন,

একটা মোবাইল বিক্রির ফলে মালিকের লাভ ১০০ টাকা,

শ্রমীকের বেতন বাবদ যায় ১০ টাকা। অর্থাৎ মালিক শ্রমিক পার্থক্য ৯০ টাকা।


অর্থাৎ যদি কেরামত আলী ৪টা মোবাইল কিনতেন তাহলে মালিক পেত ৪০০ টাকা, আর শ্রমীক পেত ৪০ টাকা,

মালিক শ্রমিক ব্যবধান ৩৬০ টাকা।

 

অতিরিক্ত আরো ৩টা মোবাইল কেনার ফলে  মালিকের টোটাল লাভ হয় ৭০০ টাকা ও শ্রমীক পায় ৭০ টাকা,

পার্থক্য ৬৩০ টাকা। 


অর্থাৎ প্রতি পণ্যের জন্য শ্রমীক ও মালিকের মুনাফার পার্থক্য বেড়েই যাচ্ছে। 

 মালিক যত মুনাফা লাভ করবে তারা যতবেশি Exploitation করবে।

 

সে যাক, 

মোবাইল বানানোর জন্যে যে সকল সম্পদের প্রয়োজন তা নির্দিষ্ট। উপাদানের নির্দিষ্টতার জন্যে নির্দিষ্ট সংখ্যক পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব হলে, এবং যদি অতিরিক্ত পণ্য যদি বেশি টাকা মানুষগুলোই কিনে নেয় তাহলে খুব সঙ্গত ভাবেই বাকি থাকা পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে। এক্ষেত্রে পণ্য গরীব মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। আর পণ্যটা যদি কিনতেই হয়, সেক্ষেত্রে তাদের জমানো টাকা খরচ করতে হবে বা লোন নিতে হবে। অর্থাৎ যে অর্থ দিয়ে বিনিয়োগ করা যেত তা হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। 

এবং একটা সময়ে এমন হয়ে যাবে যে, পণ্য উৎপাদন কিংবা অর্থনীতি ধনী সমাজ কেন্দ্রীক হয়ে যাচ্ছে। 


দিনদিন যদি মানুষ অপ্রয়োজনে পণ্য ক্রয় করতে থাকে তাহলে অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। 


এখন কথা হচ্ছে, 

প্রয়োজনে কিনলেও তো এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে!


এটা একটা সম্ভাবনা।  হতে পারে। তবে সাধারণত দিন দিন নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়। পণ্য উৎপাদনের নতুন কলাকৌশল এর জন্যে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায়। এতে Waste কমে, এমন কি ভিন্ন নতুন উৎপাদন কৌশলের জন্যে কাঁচামাল কম লাগে কিংবা অন্য কাচাঁমাল দিয়েও পণ্য উৎপাদন সম্ভব হয়।


তাও একটা সময়ে যদি সকল সম্পদ ফুরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, তখন Possession নির্দিষ্ট করে দেওয়া একটা উপায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এটাও অবশ্য সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে দেখা যায়। 


অনেক দেশে দেখা যায়, ট্রাফিক জ্যাম এর জন্যে এক পরিবার এক গাড়ির নিয়ম করা হয়েছে। সেসব দেশে কেউ চাইলেই ২/৩টা গাড়ি কিনতে পারছে না। এটাও Possession Limitation এর একটা উদাহরণ। এতে পণ্যের দাম কমে যায়, এবং পণ্যের পূর্ণ উপযোগ ভোগ করার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। 

 

সমাজে সম্পদের বন্টন ও ক্রয়ের সমান সুযোগ নিশ্চিত করার জন্যে তাই প্রয়োজনের বাইরে সম্পদের Possession নিরুৎসাহিত করা উচিত।


Post a Comment

Previous Post Next Post